প্যালিওজোয়িক যুগের ভূ-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্য (Geomorphological Characteristics of the Paleozoic Era)
প্যালিওজোয়িক যুগ (Paleozoic Era) পৃথিবীর ভূতাত্ত্বিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়কাল, যা প্রায় ৫৪০ মিলিয়ন বছর আগে শুরু হয় এবং প্রায় ২৫০ মিলিয়ন বছর আগে শেষ হয়। এই যুগের সময় পৃথিবীর ভূ-আকৃতিগত এবং জলবায়ুগত পরিবর্তনগুলি জীবজগতের বিবর্তন এবং বৈচিত্র্যকেও প্রভাবিত করেছে।
প্যালিওজোয়িক যুগের ভূ-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ:
১. মহাদেশগুলির গঠন ও স্থানান্তর:
প্যালিওজোয়িক যুগের শুরুতে পৃথিবীর বেশিরভাগ স্থলভাগ কয়েকটি ছোট মহাদেশে বিভক্ত ছিল। সময়ের সাথে সাথে, এই মহাদেশগুলি একে অপরের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়ে বৃহত্তর মহাদেশীয় ব্লক তৈরি করেছিল।
গন্ডোয়ানা (Gondwana):
দক্ষিণ গোলার্ধে গঠিত একটি বিশাল মহাদেশীয় ব্লক। গন্ডোয়ানার মধ্যে বর্তমান আফ্রিকা, দক্ষিণ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, অ্যান্টার্কটিকা, এবং ভারতীয় উপমহাদেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল।
লরেন্টিয়া এবং বাল্টিকা (Laurentia and Baltica):
উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত মহাদেশীয় ব্লকগুলি। এই ব্লকগুলি সময়ের সাথে সাথে একে অপরের সাথে মিলিত হয়ে আরও বড় মহাদেশ তৈরি করেছিল।
২. পর্বত গঠন প্রক্রিয়া (Orogeny):
প্যালিওজোয়িক যুগে বেশ কয়েকটি প্রধান পর্বত গঠন প্রক্রিয়া ঘটেছিল, যা পৃথিবীর ভূ-আকৃতিতে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছিল।
ক্যালিডোনিয়ান অরোজেনি (Caledonian Orogeny):
প্যালিওজোয়িক যুগের প্রথমদিকে উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের মহাদেশগুলির সংঘর্ষের ফলে ক্যালিডোনিয়ান পর্বতশ্রেণী গঠিত হয়।
হেরসিনিয়ান অরোজেনি (Hercynian Orogeny):
প্যালিওজোয়িক যুগের শেষদিকে গন্ডোয়ানা এবং ইউরোপীয় মহাদেশের সংঘর্ষের ফলে হেরসিনিয়ান পর্বতশ্রেণী গঠিত হয়।
৩. সমুদ্র ও মহাসাগরের প্রসারণ:
প্যালিওজোয়িক যুগে সমুদ্র এবং মহাসাগরের প্রসারণ ও সংকোচন প্রক্রিয়া চলমান ছিল।
ইপিরিক সমুদ্র (Epieric Seas):
এই সময়ে মহাদেশের ভিতরে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সমুদ্র গঠিত হয়েছিল, যা ইপিরিক সমুদ্র নামে পরিচিত। এই সমুদ্রগুলি জীববৈচিত্র্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল।
৪. প্যালিওজোয়িক যুগের জলবায়ু:
প্যালিওজোয়িক যুগে জলবায়ুগত পরিবর্তনগুলি ব্যাপকভাবে পরিবর্তিত হয়েছিল।
প্রারম্ভিক জলবায়ু:
প্যালিওজোয়িক যুগের শুরুতে পৃথিবীর জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র ছিল।
পরবর্তী সময়ের জলবায়ু:
যুগের মধ্যবর্তী সময়ে জলবায়ু ধীরে ধীরে শুষ্ক ও শীতল হয়ে ওঠে। এই সময়ে বরফ যুগ (Ice Age) শুরু হয় এবং গন্ডোয়ানা মহাদেশের বড় অংশ বরফে আবৃত হয়ে যায়।
৫. জীবাশ্ম ও জীববৈচিত্র্য:
প্যালিওজোয়িক যুগে জীবাশ্মের বৃদ্ধি এবং জীববৈচিত্র্যের বিকাশ ঘটেছিল। এই যুগের শেষে বড় আকারের জীবাশ্ম সংগ্রহ এবং জীববৈচিত্র্য ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়।
ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ (Cambrian Explosion):
প্যালিওজোয়িক যুগের প্রারম্ভিক পর্যায়ে ক্যাম্ব্রিয়ান যুগে জীববৈচিত্র্যের এক বিস্ফোরণ ঘটে, যা “ক্যাম্ব্রিয়ান বিস্ফোরণ” নামে পরিচিত। এই সময়ে পৃথিবীর জীবজগতে অনেক নতুন প্রজাতি উদ্ভব ঘটে।
পারমিয়ান গণবিলুপ্তি (Permian Extinction):
প্যালিওজোয়িক যুগের শেষে পারমিয়ান যুগে পৃথিবীর ইতিহাসের সবচেয়ে বড় গণবিলুপ্তি ঘটে, যেখানে প্রায় ৯০% সামুদ্রিক এবং ৭০% স্থলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যায়।
প্যালিওজোয়িক যুগের ভূ-আকৃতিগত বৈশিষ্ট্যগুলি পৃথিবীর বর্তমান ভূ-আকৃতির গঠন এবং জীববৈচিত্র্যের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। এই যুগের বিভিন্ন পরিবর্তন এবং ভূ-আকৃতির বিবর্তনই পৃথিবীর বর্তমান জীবজগতের ভিত্তি স্থাপন করেছে।