আবহবিদ্যা (Climatology) এবং এর সঙ্গে জলবায়ুবিজ্ঞানের (Meteorology) সম্পর্ক
আবহবিদ্যা এবং জলবায়ুবিজ্ঞান দুটি সম্পর্কিত বিজ্ঞান শাখা যা বায়ুমণ্ডলীয় ঘটনা এবং প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াগুলি অধ্যয়ন করে। যদিও এদের মধ্যে কিছু মিল রয়েছে, তবে তারা বিভিন্ন সময়সীমা এবং উদ্দেশ্যের উপর ভিত্তি করে আলাদা আলাদা বিষয়বস্তু নিয়ে কাজ করে। এখানে এই দুই শাখার মধ্যে সম্পর্ক এবং তাদের বিশেষত্ব নিয়ে আলোচনা করা হলো:
আবহবিদ্যা (Meteorology)
আবহবিদ্যা হল বায়ুমণ্ডলের অধ্যয়ন, বিশেষত স্বল্পমেয়াদী আবহাওয়ার ঘটনা ও প্রক্রিয়া। এটি আবহাওয়ার পূর্বাভাস, আবহাওয়ার ঘটনা এবং তাদের কারণগুলিকে বোঝার ওপর মনোনিবেশ করে। আবহবিদ্যায় বিভিন্ন উপাদান বিশ্লেষণ করা হয়, যেমন:
- তাপমাত্রা: আবহাওয়ার পরিবর্তনের একটি প্রধান উপাদান।
- বায়ুপ্রবাহ: বায়ুপ্রবাহের দিক এবং গতি।
- বৃষ্টিপাত: বৃষ্টি, তুষারপাত, শিলাবৃষ্টি ইত্যাদি।
- চাপ: বায়ুমণ্ডলীয় চাপের পরিবর্তন।
আবহবিদ্যার প্রধান লক্ষ্য হল স্বল্পমেয়াদী আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করা, যা কৃষি, পরিবহন, এবং দৈনন্দিন জীবনের অন্যান্য ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
জলবায়ুবিজ্ঞান (Climatology)
জলবায়ুবিজ্ঞান হল বায়ুমণ্ডল এবং ভূ-পৃষ্ঠের দীর্ঘমেয়াদী পরিবেশগত শর্তের অধ্যয়ন। এটি আবহাওয়ার চেয়ে দীর্ঘ সময়সীমা নিয়ে কাজ করে এবং বায়ুমণ্ডলীয় প্রক্রিয়াগুলির দীর্ঘমেয়াদী প্রবণতা এবং প্যাটার্নগুলি বোঝার চেষ্টা করে। জলবায়ুবিজ্ঞানে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি অন্তর্ভুক্ত রয়েছে:
- জলবায়ুর ধরন: বিভিন্ন অঞ্চলের জলবায়ুর বৈশিষ্ট্য।
- জলবায়ু পরিবর্তন: প্রাকৃতিক এবং মানবসৃষ্ট কারণগুলির জন্য দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু পরিবর্তন।
- জলবায়ুর প্রভাব: জীববৈচিত্র্য, মানব জীবন এবং পরিবেশের উপর জলবায়ুর প্রভাব।
জলবায়ুবিজ্ঞানের প্রধান লক্ষ্য হল দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু প্যাটার্ন এবং পরিবর্তনের পূর্বাভাস প্রদান করা, যা পরিবেশগত নীতি, কৃষি পরিকল্পনা এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার জন্য গুরুত্বপূর্ণ।
সম্পর্ক এবং পার্থক্য
যদিও আবহবিদ্যা এবং জলবায়ুবিজ্ঞান আলাদা শাখা, তারা একে অপরের সাথে সম্পর্কিত এবং পরিপূরক। কিছু মূল পার্থক্য এবং সম্পর্ক নিম্নরূপ:
- সময়সীমা: আবহবিদ্যা স্বল্পমেয়াদী আবহাওয়া নিয়ে কাজ করে, যেমন কয়েক ঘন্টা থেকে কয়েকদিন পর্যন্ত। জলবায়ুবিজ্ঞান দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু নিয়ে কাজ করে, যেমন কয়েক দশক থেকে কয়েক শতাব্দী পর্যন্ত।
- উদ্দেশ্য: আবহবিদ্যার উদ্দেশ্য হল তাত্ক্ষণিক আবহাওয়ার পূর্বাভাস প্রদান করা, যেখানে জলবায়ুবিজ্ঞানের উদ্দেশ্য হল দীর্ঘমেয়াদী জলবায়ু প্যাটার্ন এবং পরিবর্তন বোঝা।
- ডাটা এবং পদ্ধতি: আবহবিদ্যা এবং জলবায়ুবিজ্ঞান উভয়ই উপগ্রহ ডাটা, আবহাওয়া মডেল এবং অন্যান্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে। তবে জলবায়ুবিজ্ঞান দীর্ঘমেয়াদী ডাটা এবং পরিসংখ্যানিক বিশ্লেষণ উপর বেশি নির্ভরশীল।
উভয় শাখাই একে অপরকে পরিপূরক করে এবং পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ও পরিবেশ বোঝার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আবহবিদ্যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে আবহাওয়ার পরিবর্তন সম্পর্কে সচেতন থাকতে সহায়তা করে, যেখানে জলবায়ুবিজ্ঞান আমাদের ভবিষ্যতের জলবায়ু পরিবর্তন এবং তার প্রভাব সম্পর্কে ধারণা দেয়।
Role of climate in shaping Soil, Biosphere
পৃথিবীর সর্বত্র একই ধরনের মাটি নেই। কারণ পৃথিবীর কোথায় কী ধরনের মাটির সৃষ্টি হবে, তা কয়েকটি কারণের ওপর নির্ভর করে। রুশ মৃত্তিকা-বিজ্ঞানী ডকুচেভ মৃত্তিকার গঠনের ওপর চারটি নিয়ন্ত্রক; যথা— জলবায়ু, জীবজগৎ, শিলা ও সময়ের প্রভাব লগ করেছেন। মৃত্তিকা বিজ্ঞানী এইচ. জেনি (H. Jenny)-র মতে মৃত্তিকা সৃষ্টির পাঁচটি প্রধান কারণ আছে। মৃত্তিকার সৃষ্টি প্রসঙ্গে জেনি কে কার্যকারণভিত্তিক সমীকরণটি (functional equation) দিয়েছেন, তা নীচে দেওয়া হল—
s = f (cl, o, r, p, t …………)
যেখানে, s = মৃত্তিকা (soil), f = কার্যকারণ (function), cl = জলবায়ু (climate), o = জীবজগৎ (organism), r = ভূপ্রকৃতি (relief), p = আদিশিলা বা জনকশিলা (parent material), t = সময় (time) |
মৃত্তিকা সৃষ্টির কারণগুলিকে কার্যকারিতার ওপর ভিত্তি করে দু’ভাগে ভাগ করা যায়। যথা—
1. সক্রিয় কারণসমূহ (Active Factors):
(i) জলবায়ুর প্রভাব (Influence of climate):
মৃত্তিকা সৃষ্টির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল জলবায়ু। বৃষ্টিপাত ও তাপমাত্রা – জলবায়ুর এই দুটি উপাদান প্রত্যক্ষভাবে মৃত্তিকা সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করে। যেমন—
বৃষ্টিপাতের ভূমিকা (Role of rainfall):
- বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যেখানে বেশি, যেমন আর্দ্র জলবায়ু অঞ্চল, সেখানে আবহবিকার প্রক্রিয়া তরান্বিত হয়। ফলে শিলা দ্রুত চূর্ণবিচূর্ণ ও বিয়োজিত হয়। এই কারণে আর্দ্র অঞ্চলের মাটিতে কাদার পরিমাণ বেশি। যেমন— এঁটেল মাটি।
- বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে মাটি আম্লিক (acidic) প্রকৃতির হয়।
- অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে মাটির ওপরের স্তর থেকে ক্যালশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম, সোডিয়াম প্রভৃতি দ্রবণীয় ক্ষারকীয় পদার্থগুলি অনুসরণ (percolation)-এর মাধ্যমে ধৌতি প্রক্রিয়ায় অপসারিত হয়। পক্ষান্তরে, স্বল্প বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে এই ক্ষারকীয় পদার্থগুলি মাটির ওপরের স্তরে সঙ্কিত থাকে।
- বৃষ্টিপাতের পরিমাণ বেশি হলে মাটিতে উদ্ভিজ্জের আবরণ ঘন হয় ও মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ বাড়ে।
- অধিক বৃষ্টিপাতযুক্ত অঞ্চলে মৃত্তিকার স্তরগুলি পুরু (thick) হওয়ার ফলে গভীর (deep) মাটির সৃষ্টি হয়। সাধারণত বৃষ্টিপাতের পরিমাণ যত কমে, মাটি তত অগভীর হয় ।
তাপমাত্রার ভূমিকা (Role of temperature):
বিজ্ঞানী ভ্যান্ট হফ্ (Vant Hoff, 1884)-এর মতে, প্রতি 10 °সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে রাসায়নিক বিক্রিয়ার হার দ্বিগুণ বাড়ে। তাই শীতল মেরু অঞ্চলের তুলনায় উষ্ম-ক্রান্তীয় ও নিরক্ষীয় অঞ্চলে মৃত্তিকা সৃষ্টির হার দ্রুত।
- তাপমাত্রা বাড়লে আবহবিকারের কার্যকারিতা বাড়ে। ফলে পুরু রেগোলিথ-এর উৎপত্তি হয় এবং মাটির গভীরতা বাড়ে।
- অধিক উষ্ম অঞ্চলে মাটিতে কাঁচা জৈব পদার্থের পরিমাণ কম হয় এবং মাটিতে নাইট্রোজেনের পরিমাণ হ্রাস পায়।
- তাপমাত্রা বেশি হলে মাটিতে কাদা জাতীয় খনিজ যেমন— কেওলিনাইট, মন্টমোরিলোনাইট ইত্যাদির পরিমাণ বেশি হয়।
- অধিক তাপমাত্রার জন্য মরু ও মরুপ্রায় অঞ্চলের মাটি শুষ্ক ও লবণাক্ত হয়।
(ii)জীবজগতের প্রভাব (Influence of organisms):
উদ্ভিদ ও প্রাণীজগতের প্রত্যক্ষ প্রভাবে মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়। প্রাণী ও উদ্ভিদের বর্জ্য দেহাবশেষ বিয়োজিত হয়ে মাটিতে হিউমাস (humus)-রূপে সংযোজিত হয়। ফলে মাটির পুষ্টিগুণ বাড়ে। মাটি উর্বর হয়। এই কারণে উদ্ভিজ্জের আবরণ যেখানে কম মাটিতে হিউমাসের পরিমাণও সেখানে কম।
- মাটিতে হিউমাসের পরিমাণ বাড়লে মাটির জলধারণ ক্ষমতাও বাড়ে।
- প্রেইরি ও স্তেপ তৃণভূমি অঞ্চলে জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ চারনোজেম মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়।
- পাইন গাছের বনাঞ্চলে আম্লিক পড়সল মৃত্তিকার উদ্ভব হয়।
- জৈব পদার্থে সমৃদ্ধ মাটির রং কালো।
- মাটির গর্তে বসবাসকারী প্রাণীরা, যেমন— ছুঁচো, কেঁচো, পিঁপড়ে, কেন্নো, উই ইত্যাদি মাটির ওপর ও নীচের স্তরের মধ্যে মিশ্রণ ঘটায়। ফলে মাটিতে বায়ু চলাচল করা সহজ হয় ও মাটি আলগা হয়।
- কেঁচোর মল নাইট্রোজেন ও ক্যালশিয়ামসমৃদ্ধ। ফলে কেঁচোর উপস্থিতি মাটিকে উর্বর করে। তাই কেঁচোকে “কৃষকের বন্ধু” বলা হয়।
2. নিষ্ক্রিয় কারণসমূহ (Passive Factors):
(i) ভূপ্রকৃতির প্রভাব (Influence of relief):
ভূপৃষ্ঠের উচ্চতা, বন্ধুরতা ও ঢাল প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে মৃত্তিকার সৃষ্টিকে প্রভাবিত করে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, একই প্রকার আদিশিলা ও জলবায়ুযুক্ত অঞ্চলে ভূপ্রকৃতির পার্থক্যের জন্য স্থানীয় ভূমিরূপ অনুসারে যে মৃত্তিকা গঠিত হয়, তাকে মৃত্তিকা ক্যাটেনা (soil catena) বলে। মৃত্তিকা সৃষ্টির ক্ষেত্রে ভূপ্রকৃতির প্রভাব হল-
- পাহাড়ি অঞ্চলের ভূমিঢাল শতকরা 16 ভাগের বেশি। অধিক ভূমিঢালের জন্য এখানে ভূমিক্ষয়ের পরিমাণ বেশি। পাহাড়ি অঞ্চলের মাটি অগভীর ও মাটির স্তর পাতলা (50 থেকে 100 সেমি-র মধ্যে)।
- মাঝারি ঢালযুক্ত ভূমিতে (ঢালের পরিমাণ শতকরা ৪ থেকে 16 ভাগ) মাটির গভীরতা মাঝারি ধরনের (50 থেকে 150 সেমি-র মধ্যে)। এই মাটিতে অনুষরণ (percolation)-এর পরিমাণ কম হয়।
- সমভূমি অঞ্চলে যেখানে ভূমিঢালের পরিমাণ শতকরা ৪ ভাগের কম সেখানে বৃষ্টিপাত পর্যাপ্ত হলে মাটিতে অনুসরণ বৃদ্ধি পায়। ধৌতি প্রক্রিয়ায় দ্রাব্য পদার্থগুলি মাটির ওপরের স্তর থেকে অপসারিত হয়। মাটির গভীরতা বেশি হয়।
- উত্তর গোলার্ধে অবস্থিত উচ্চভূমির দক্ষিণ ঢাল উত্তর ঢালের তুলনায় বেশি আলোকিত এবং উম্ম। সুইজারল্যান্ডের পাহাড়ি অঞ্চলে সমীক্ষা চালিয়ে মৃত্তিকা-বিজ্ঞানীরা লক্ষ করেছেন উত্তর ঢালে উম্মতা কম থাকার জন্য আম্লিক পড়সল মৃত্তিকার সৃষ্টি হয়েছে, কিন্তু দক্ষিণ ঢালে উম্মতা বেশি বলে ক্ষারকীয় চুনময় মৃত্তিকা (Calcareous soil) গঠিত হয়েছে।
- আর্দ্র নিম্নভূমি অঞ্চলে সেই মৃত্তিকা (Glei soils), জলাভূমি অঞ্চলে বগ মৃত্তিকা (Bog soils) প্রভৃতির সৃষ্টি হয় (প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, ইংরেজি ‘বগ’ কথাটির অর্থ হল জলাভূমি বা বিল)।
(ii) আদিশিলা বা জনকশিলার প্রভাব (Influence of parent material):
আবহবিকার, ক্ষয় ও সঞ্চয়ের মাধ্যমে আদিশিলা পরিবর্তিত হয়ে মৃত্তিকার সৃষ্টি করে। আদিশিলার ভৌত রাসায়নিক বৈশিষ্ট্য মাটিকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। যেমন-
- গ্রানাইট ও রায়োলাইট শিলা থেকে বেলেমাটি (sandy soil) উৎপন্ন হয়। বেলেমাটিতে বালির ভাগ বেশি থাকায় জলধারণ ক্ষমতা কম ও এই মাটি অম্লধর্মী।
- ব্যাসল্ট শিলা থেকে এঁটেল মাটি (clay) উৎপন্ন হয়। এঁটেল মাটি মৃদু ক্ষারধর্মী ও এই মাটির জলধারণ ক্ষমতা বেলেমাটির তুলনায় বেশি।
- সিস্ট (schist) শিলা থেকে উৎপন্ন মাটিতে কাদার কণা (clay particles) বেশি হয়। এই মাটিতে অ্যালুমিনিয়াম ও ম্যাগনেশিয়ামের আধিক্য লক্ষ করা যায়।
- গ্রাবরেখা বা হিমগ্রাব (moraine) থেকে সাধারণত এঁটেল-দোআঁশ অথবা বেলে-দোআঁশ মাটি উৎপন্ন হয়।
- আদিশিলায় লোহা ও ম্যাঙ্গানিজ যৌগের আধিক্য হলে মাটি লাল রং ধারণ করে।
- আদিশিলায় চুনের পরিমাণ বেশি থাকলে মাটি দৃঢ় ও সুগঠিত হয়।
(iii) সময়ের প্রভাব (Influence of time):
প্রাকৃতিক পরিবেশে একটি পরিণত মৃত্তিকা সৃষ্টি হতে কয়েক হাজার বছর সময় লাগে। বিজ্ঞানীরা হিসেব করে দেখেছেন যে, মাত্র দুই সেন্টিমিটার পুরু মাটির স্তর তৈরি হতে কয়েকশো বছর সময় নেয়। তাই মৃত্তিকা সৃষ্টির প্রক্রিয়া অত্যন্ত ধীর।