জনসংখ্যা বৃদ্ধি সম্পর্কিত ম্যালথাসের তত্ত্ব (The Malthusian theory of population growth)

Malthus, Karl Marx, Adam Smith প্রমুখ চিন্তাবিদগণ অষ্টাদশ শতাব্দীরতে তাদের জনসংখ্যা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কিত চিন্তাধারা তুলে ধরেছেন । তবে তাদের মধ্যে সর্বপ্রথম জনসংখ্যা গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আলোকপাত করেনT.R.Mathur টমাস রবার্ট ম্যালথাস হলেন একজন ব্রিটিশ অর্থনীতিবিদ। ম্যালথাস 1766 খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন ।1798 খ্রিস্টাব্দে জনসংখ্যা ও খাদ্য উৎপাদনের মধ্যে সম্পর্ক বিষয়ক যে বক্তব্য T. R. Malthus প্রদান করেন তাই ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্ব বা ম্যালথাসীয় জনসংখ্যা তত্ত্ব নামে বিবেচিত। ম্যালথাসের তত্ত্বকে অনেকেই জনসংখ্যার জৈবিক ও সামাজিক তত্ত্ব হিসাবে গণ্য করেন।

ম্যালথাসের তত্ত্বের পটভূমিকা (Background of Malthusian Theory):

ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের উপর তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির প্রভাব পড়েছিল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইংল্যান্ড বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যুদ্ধরত থাকায় খাদ্য শষ্যের মূল্য ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে বাড়তে থাকে সমাজে দারিদ্র, দুর্ভিক্ষ, বেকারত্ব। অষ্টাদশ শতাব্দীতে সৈন্যশক্তি বাড়ানোর জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রবলভাবে সমর্থন করা হয়। যার ফলে সমাজে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রতি কোনো লক্ষ্য ছিল না। ম্যালথাসের মতে সমাজে তখন খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা বৃদ্ধি দ্রুত গতিতে হয়ে থাকে। এই সময় সমাজ দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত হয়ে যায়, যথা—ধনী ও দরিদ্র। ম্যালথাসের মতে যে অনুপাতে জনসংখ্যা বাড়ছিল সেই অনুপাতে উৎপাদন বাড়ছিল না। শিল্পবিপ্লবের ফলে এই সময় নানা সমস্যার সৃষ্টি হয়। সমাজের পুঁজিপতি শ্রেণী অর্থাৎ ধনীরা আরো ধনী হয় এবং শ্রমিক শ্রেণী বা নিম্নশ্রেণী অর্থাৎ দরিদ্র আরও দরিদ্র হতে থাকে। সরকারের শাসন ব্যর্থতার সঙ্গে যে দারিদ্রতা যুক্ত তা তিনি লক্ষ্য করেছিলেন। ম্যালথাস মনে করেন যে সরকার জনসংখ্যা বৃদ্ধিতে সাহায্য করছে কারণ সরকার এর দ্বারা যুদ্ধের জন্য সৈনিক পাবে। রবার্ট ম্যালথাসের প্রভাবে পড়ে তৎকালীন লেখক ওয়াল্টার র‍্যালে ম্যানুয়েল, রবার্ট ওয়েলস্, যোসেফ টাউন সেন্ট, উইলিয়াম গাটবিন প্রমুখের বিচার ধারায়। স্যার ওয়ালটার র‍্যালে তাঁর “বিশ্বের ইতিহাস’ গ্রন্থে বলেন যে বুদ্ধ ব্যাধি নিয়ণ না করা গেলে জনসংখ্যা এতটাই বৃদ্ধি পাবে যে তার ভরনপোষণ করা কঠিন হয়ে যাবে। ম্যাধু হেল তাঁর নিজ গ্রন্থ মানবতার আদিম উৎপত্তি’তে বলেন যে সাধারণভাবে মৃত্যুর চেয়ে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে তা বাড়তেই থাকবে। তিনি বলেছিলেন জনসংখ্যা গুণিতক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এভাবে চলে 34 বছরে তা দ্বিগুণ হবে।

1793 সালে উইলিয়াম গাডবিনের বই— Enquiry Concerning Political justice and its influence on Morals and Happiness’ প্রকাশিত হয়। যাতে তিনি সরকারি নীতিক দেশের দারিদ্রতা ও দুঃখের জন্য দায়ী করেন। উইলিয়াম গাভবিনের ধারণা ছিল যে জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে কোনো রকম ক্ষতি তো হচ্ছেই না বরং লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। ম্যালথাসের কাছে এই ধারণা প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ হয়ে যায় এবং তিনি এর প্রবল বিরোধিতা করেন এবং রচনার মাধ্যমে নিজের মতামত ব্যক্ত করেন।

অনুমান (Assumption of Malthusian Theory) 

ম্যালথাসের তত্ত্ব ব্যাখ্যা কতকগুলি অনুমানের উপর নির্ভরশীল। অনুমানগুলি হল—

• মানুষের জীবনধারণের জন্য প্রয়োজন খাদ্য।
• কোন দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে খাদ্যের জোগানের অপরিহার্য ভূমিকা রয়েছে।
• মোট জমি ও উৎপাদন ক্ষমতা স্থির থাকবে।
• কৃষিক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান বিধি প্রযোজ্য।
• খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও সরবরাহের উন্নতি ঘটলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে।
• নরনারীর মধ্যে আকর্ষণ প্রয়োজনীয় এবং সম্পর্ক সর্বজনীন।
• শিশু ধারন ও জীবনযাত্রার মধ্যে প্রত্যক্ষ সম্পর্ক।
• প্রতিরোধক (Preventive) ও অনিবার্য ব্যবস্থা (Positive Check)-এর দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে।
• কৃষিই একমাত্র উৎপাদন ব্যবস্থা।  
• উৎপাদন প্রযুক্তি স্থির।

ম্যালথাসের তত্ত্বের মূল বক্তব্য (Basic Proposal of Malthusian Theory):

ম্যালথাস তাঁর গ্রন্থ ‘An Essay on the Principle of Population…’ এ জনসংখ্যা বৃদ্ধি সংক্রান্ত এক যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেন। ম্যালথাস মানব সম্পদকে দুটি উপাদানের ভিত্তিতে ব্যাখ্যা করেন যথা— জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগান। ম্যালথাসের তত্ত্বের মূল ভিত্তি ছিল—জনসংখ্যা অনিয়ন্ত্রিত ব্যবস্থায় জ্যামিতির হারে বৃদ্ধি পাবে অপরদিকে জীবনধারনের উপকরণ খাদ্যের জোগান বৃদ্ধি পাবে গাণিতিক হারে। তার মতে গুণোত্তর হারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাবে কিন্তু খাদ্যের জোগান সমান্তরাল হারে বৃদ্ধি পাবে। অর্থাৎ জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগান বৃদ্ধি কখনই সমান হবে না। সেই কারণেই ক্রমাগত অনিয়ন্ত্রিতভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের চাহিদা ও খাদ্যের যোগানের মধ্যে সামঞ্জস্য কখনও থাকবে না ফলে খাদ্য সমস্যা অনিবার্য। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বে খাদ্যের জোগান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ব্যাপক অর্থে ব্যাবহার করেছেন। উদাহরণ হিসাবে দেখানো যায় যে—

ম্যালথাসের তত্ত্বের ব্যাখ্যা (Explanation of Malthusian Theory):

ম্যালথাস মানবসম্পদকে দুই উপাদানের উপর ভিত্তি করে ব্যাখ্যা করেছেন, যথা— জনসংখ্যা ও খাদ্যের জোগান। ম্যালথাস তাঁর তত্ত্বে খাদ্যের জোগান ও জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে ব্যাপক অর্থে ব্যবহার করেছেন—

i) জনসংখ্যার জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি :

সুষ্ঠু পরিবেশে মানব সমাজের প্রজনন ক্ষমতা ও প্রজনন সম্ভাবনা অন্যান্য প্রাণীর মতো খুবই বেশি। ম্যালথাসের মতে মানুষের বিপরীত লিঙ্গের প্রতি কামভাব জাগরিত হয় এবং স্বাভাবিক নিয়মে সন্তানোৎপাদন প্রক্রিয়া কার্যকরা হয়। এবং এই প্রজনন ক্ষমতা অনিয়ন্ত্রিত। ম্যালথাসের মতে এই প্রজনন ক্ষমতা কোনো বাধা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত না করতে পারলে তবে তা গুণিতক হারে (1:2:4:8:16:32:64 128 ইত্যাদি) বৃদ্ধি পাবে। ম্যালথাসের মতে কোনো রকম বাধা বা প্রতিবন্ধকতা অভাবে এই জনসংখ্যা 25 বছরে দ্বিগুণ হবে। এবং এই ধারা বজায় থাকলে তবে 200 বছরে জনসংখ্যা 256 গুণ বৃদ্ধি পাবে। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে এক ভয়ংকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে। কারণ – “Prosperity was not depend on population but population was to depend on prosperity.”

ii খাদ্যের গাণিতিক হারে বৃদ্ধি :

মানুষের বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যের প্রয়োজন। ম্যালথাসের মতে কোনো দেশের জনসংখ্যার আকার সেই দেশের পদার্থ দ্বারা নির্ধারিত হয়। তবে খাদ্যের উৎপাদন কিংবা যোগান পরিমান সীমিত। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যোভাব সৃষ্টি হয়। খাদ্যের জোগান জনসংখ্যার ওপর প্রভাব বিস্তার করে। অনিয়ন্ত্রিত ভাবে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের জোগানের উপর টান পড়বে। ম্যালথাসের মতে খাদ্যবস্তুর বৃদ্ধি গাণিতিক অনুপাতে (1:2:3:4:5:6:7:8) হয়। কিন্তু জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায় গুণোত্তর হারে। ফলে জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেলে খাদ্যের অভাব দেখা যায়। এছাড়া কৃষি ক্ষেত্রে ক্রমহ্রাসমান প্রতিদানের নিয়ম কার্যকরী হওয়ায় কৃষি উৎপাদনের একটি সীমার পর হ্রাসের প্রবণতা দেখা যায়।

ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা তীব্রগতিতে জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পায় কিন্তু খাদ্যসামগ্রী গাণিতিকহারে বৃদ্ধি পায় জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে প্রতিবন্ধকতা বা নিয়ন্ত্রণ না করা হয় তবে খাদ্য উৎপাদনের তুলনায় জনসংখ্যা অত্যাধিক বেড়ে যাবে। ফলে বেকারত্ব, দারিদ্রতা, দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। ম্যালথাসের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও খাদ্যের জোগানের মধ্যে যে ফারকটি সৃষ্টি হয়েছে তা কয়েক শতাব্দীর পরে ভীষণ রকম বাড়বে। কিন্তু একজন অর্থনীতিবিদ হিসাবে তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে মেনে বলেনি তাই তিনি জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের জন্য কতকগুলি ব্যবস্থার কথা বলেন। যথা–

(i) অনিবার্য ব্যবস্থা (Positive Check):

কিছু ঘটনা এমন আছে যেগুলি প্রকৃতিতে অনিবার্যভাবে ঘটে থাকে যা জনসংখ্যাকে নিয়ন্ত্রণ করে। মহামারি, দুর্ভিক্ষ, যুদ্ধ কন্যা, ভূমিকম্প ইত্যাদি দুর্যোগ জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ করে। বর্ধিত জনসংখ্যা কমে গেলে জনসংখ্যা ও খাদ্যের যোগানের মধ্যে সমতা স্থাপন হয় কিন্তু এই সমতা খুবই অল্প সময়ের জন্য হয় কারণ মানুষের প্রজনন ক্ষমতা ক্রিয়াশীল হলে জনসংখ্যা আবার দ্রুতগতিতে বাড়তে থাকে এবং কয়েক বছরের মধ্যে জনসংখ্যা খাদ্যের জোগানের তুলনায় পুনরায় বেড়ে যায়। প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রণের সাহায্যে মৃত্যুহার বেড়ে যায় ফলে জনসংখ্যা কম হয়। 

(ii) প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা (Preventive Check):

এক্ষেত্রে ম্যালথাস মানুষের নিজস্ব চারিত্রিক কারণকে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। হালথাসের মতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ প্রাকৃতিক নিয়ন্ত্রকের মাধ্যমে মানুষের কাছে কষ্টদায়ক। তাই তিনি বলেন যে মনুষ যদি প্রতিবন্ধক পদ্ধতির সাহায্যে জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে তবে তা প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে তাকে বাঁচাতে পারে। তিনি আরও বলেন যে মানুষের প্রতিবন্ধকের এমন পদ্ধতি গ্রহণ করা উচিত যাতে এমন অবস্থার সৃষ্টি না হয় যে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য প্রকৃতিকে আবার সচেষ্ট হতে হয়।

ম্যালথাস জনসংখ্যা বৃদ্ধিকে পাপ কাজ বলে মনে করতেন। তিনি মনে করতেন মানুষের শিক্ষা, সংস্কৃতি, রুচিবোধ, জলিসে উন্নতর জীবনযাত্রা মানুষের জন্ম নিয়ন্ত্রণে উৎসাহী হবে। ম্যালথাস আত্মসংযমকেই জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের প্রধান ও প্রভাবশালী নারী বলে মনে করতেন। প্রতিবন্ধক নিয়ন্ত্রণ অর্থে তিনি বলেন যে আত্মসংযম, ব্রহ্মচর্য পালন, বিবাহ না করা বা দেরি করে বিবাহ করা ইত্যাদি।

ম্যালথাস জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য বেশ কিছু প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা বললেও তিনি মানুষের দ্বারা জনসংখ্যা বৃদ্ধি লা নিয়ন্ত্রণে আশাবাদী ছিলেন না। কারণ তিনি বিশ্বাস করতেন যে মানুষের বেঁচে থাকার জন্য ন্যূনতম খাদ্যের জোগান অচিরেই মুখ থুবড়ে পড়বে এবং তার অবশ্যম্ভাবী পরিণাম হবে সামাজিক বিপর্যয়।

ম্যালথাসের তত্ত্বের সমালোচনা/ত্রুটি (Criticisms of Malthusian Theory):

i) ম্যালথাস কৃষি প্রযুক্তি ও সংশ্লিষ্ট কারিগরী বিদ্যার প্রয়োগের মাধ্যমে কৃষিজাত পণ্যের উৎপাদন বিষয়টি চিন্তা ‌করেননি। ফলে যন্ত্রপাতি ব্যবহার, জলসেচের সুবিধা, সার ও কীটনাশক ব্যবহার ইত্যাদি মাধ্যমেও যে খাদ্যের যোগান বাড়ানো যায়, সেই সম্পর্কে ম্যালথাস নীরব থেকেছেন।

ii) প্রাণীজগতে সংখ্যা বৃদ্ধির একটি জৈবিক বা জীববিজ্ঞান ভিত্তিক সীমা আছে। প্রাণীজগতে অন্যতম সদস্য হল মানুষ। সুতরাং সংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্নে মানুষের ক্ষেত্রে একই জৈবিক শর্ত অনুসৃত হবে—এটাই স্বাভাবিক।

iii) শিল্পজাত দ্রব্যের বিনিময়ে বিদেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আমদানি করা যায় যা ম্যালথাস বিবেচনা করেনি।

iv) ম্যালথাসের মতে অতিরিক্ত জনসংখ্যা তথা শ্রমের যোগান মানুষের দুঃখদুর্দশার মূল কারণ। কিন্তু মানুষের জীবন যাত্রা এবং জীবনধারনের উপাদান শ্রমের যোগান নয়, বরং চাহিদার উপর নির্ভরশীল।

ম্যালথাসের তত্ত্বের গুরুত্ব/মূল্যায়ন (Importance of Malthus Theory):

ম্যালথাসের তত্ত্বের তীব্রভাবে সমালোচনার সত্ত্বেও তা আজও স্থির ও অবিচল হয়ে রয়েছে। মার্শাল, কোসা প্রমুখ অনেক অর্থনীতিবিদ ম্যালথাসের তত্ত্ব সমর্থন করেছেন। সুখ ও সমৃদ্ধির দিনে আমরা ম্যালথাসকে ভুলে থাকতে পারি কিন্তু যখনই খাদ্য ও ভোগ্যপণ্য সরবরাহের অনিশ্চয়তা ফিরে আসে এবং তার সঙ্গে যুক্ত হয় দ্রুতহারে জনসংখ্যা বৃদ্ধি তখনই আমরা ম্যালথাসকে স্মরণ করি তাঁর সাবধানবাণী আমাদের দ্রুত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণে প্ররোচিত করে। যখনই ভোগ্যপণ্যের সরবরাহ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির হারের ব্যবধান বিপজ্জনক সীমার কাছাকাছি এসে যাবে তখনই ম্যালথাস এর সূত্রের কার্যকারিতা লাভ করবে। ম্যালথাসের তত্ত্বের মধ্যে যে সত্যতা নিহিত আছে আমরা তা অস্বীকার করতে পারি না। ম্যালথাসের জনসংখ্যা তত্ত্বের গুরুত্বগুলি হল-

i) আমেরিকা ও ইউরোপের মানুষের উপর ম্যালথাসের সতর্কতার গভীর প্রভাব পড়েছে। সম্ভবত সেই কারণে  সেখানকার মানুষ জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৃত্রিম পদ্ধতির অধিক ব্যবহার করে যাতে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার অত্যন্ত মৃদু বা স্থির হয়ে থাকে।

ii) যখন কোনো দেশে জনসংখ্যা এতটাই বেড়ে যায় যে ভূমিসমস্যা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় তখন ব্যক্তি প্রতি আয় কমে যাওয়ার কারণে দারিদ্রতা, বেকারত্ব, অনাহার ইত্যাদি খুব স্বাভাবিকভাবেই বেড়ে যায় যা নিবারণের জন্য জনসংখ্যার হ্রাসই একমাত্র পথ কারণ ভূমি বৃদ্ধি সম্ভব নয়। তাই অনগ্রসর ও উন্নয়নশীল দেশের পরিপ্রেক্ষিতে ম্যালথাসের তত্ত্ব বেশি সঠিক বলে মনে হয়।

iii) ম্যালথাসের বক্তব্য ছিল যে কৃত্রিম নিয়ন্ত্রক ব্যবহার না করলে জনসংখ্যা গুণিতক হারে (তীব্রগতিতে) বাড়তে থাকবে—একথা মিথ্যা নয়। পাশ্চাত্য দেশে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার কারণ কৃত্রিম প্রতিরোধ ব্যবহার।

iv) ম্যালথাসই প্রথম যিনি জনসংখ্যাবৃদ্ধির হার কেমন করে রোধ করা যেতে পারে সে বিষয়ে সুদৃঢ় মতামত প্রকাশ করেন। জন্মহার নিয়ন্ত্রণে প্রতিষেধক প্রতিরোধ ব্যবস্থার কথা তিনিই প্রথম বলেন।

v) ম্যালথাসের চিন্তাভাবনার প্রভাব পড়ে অর্থনীতি ও জীববিদ্যার ওপর। তিনি বলেন, শ্রমিকের জোগান যখনই কমে, শ্রমমূল্য তখনই ঊর্ধ্বগামী হয়। অধিক উপার্জন জনসংখ্যা বৃদ্ধি ঘটায়, শ্রমবাজারে অশুভ প্রতিযোগিতা, শ্রমমূল্য হ্রাস। সেইজন্যই দরিদ্র শ্রমিকশ্রেণি কখনই তাদের সামাজিক অর্থনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন করতে পারেন না।

ভারত ও চীনের জনসংখ্যা নীতির তুলনা: 

ভারত এবং চীন, বিশ্বের দুটি জনবহুল দেশ, তাদের বিশাল জনগোষ্ঠী নিয়ন্ত্রণে বিভিন্ন নীতি গ্রহণ করেছে। উভয় দেশের জনসংখ্যা নীতি বিভিন্ন সময়ে পরিবর্তিত হয়েছে, যার মধ্যে বৈশিষ্ট্যগত পার্থক্য রয়েছে। এখানে ভারত ও চীনের জনসংখ্যা নীতির তুলনা করা হলো:

ভারতের জনসংখ্যা নীতি

1. পরিবার পরিকল্পনা (Family Planning):
ভারত তার জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা নীতি গ্রহণ করে, যা ১৯৫২ সালে প্রথম চালু হয়। এটি ছিল বিশ্বের প্রথম পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি। এই নীতি পরিবারের আকার কমাতে এবং প্রজনন হার নিয়ন্ত্রণে গর্ভনিরোধক ব্যবহারের উপর গুরুত্ব দেয়।

2. দুই সন্তান নীতি (Two-Child Policy) প্রস্তাব:
ভারতের কিছু রাজ্যে, বিশেষ করে উত্তর প্রদেশ, রাজস্থান এবং মধ্যপ্রদেশে, দুই সন্তান নীতি চালু করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এই নীতির মাধ্যমে দুটি সন্তানের বেশি সন্তানের বাবা-মাকে সরকারী সুবিধা থেকে বঞ্চিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে, তবে এটি জাতীয় পর্যায়ে এখনো বাস্তবায়িত হয়নি।

3. মহিলাদের ক্ষমতায়ন (Women’s Empowerment):
ভারতের জনসংখ্যা নীতি মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর গুরুত্ব দেয়। সরকার শিক্ষার প্রসার, মহিলাদের জন্য কর্মসংস্থান এবং স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়নের মাধ্যমে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমাতে চেয়েছে। মহিলাদের জন্য স্ব-নির্ধারণ ক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে প্রজনন হার কমানোর প্রচেষ্টা করা হচ্ছে।

4. জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব:
ভারতে জনসংখ্যা বৃদ্ধি এখনও একটি বড় সমস্যা। উচ্চ জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বেকারত্ব, দারিদ্র্য, এবং জনসাধারণের উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। তবে ভারতের পরিবার পরিকল্পনা নীতিগুলি কিছু ক্ষেত্রে সফল হয়েছে, বিশেষ করে দক্ষিণ ভারতীয় রাজ্যগুলিতে, যেখানে জন্মহার উল্লেখযোগ্যভাবে কমানো হয়েছে।

চীনের জনসংখ্যা নীতি

1. এক সন্তান নীতি (One-Child Policy):
চীনের জনসংখ্যা নীতি বিশেষভাবে পরিচিত তার এক সন্তান নীতির জন্য, যা ১৯৭৯ সালে চালু হয়। এই নীতি অনুযায়ী, শহুরে পরিবারগুলির জন্য একটির বেশি সন্তান রাখার অনুমতি ছিল না। এক সন্তান নীতি চীনের জনসংখ্যা বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা পালন করে, তবে এটি সমাজে বিভিন্ন সমস্যারও জন্ম দিয়েছে, যেমন লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা এবং বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি।

2. দুই সন্তান নীতি (Two-Child Policy):
এক সন্তান নীতি থেকে উদ্ভূত সমস্যাগুলি সমাধানের লক্ষ্যে চীন ২০১৫ সালে দুই সন্তান নীতি চালু করে। এই নীতির মাধ্যমে পরিবারগুলিকে দুটি সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়। এর মাধ্যমে চীন তাদের কর্মক্ষম জনসংখ্যা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল।

3. তিন সন্তান নীতি (Three-Child Policy):
চীনে জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার আশানুরূপ না হওয়ায় ২০২১ সালে তিন সন্তান নীতি চালু করা হয়। এই নীতির মাধ্যমে চীন পরিবারগুলিকে তিনটি সন্তান নেওয়ার অনুমতি দেয় এবং এর জন্য বিভিন্ন প্রণোদনাও দেয়া হয়, যেমন কর ছাড় এবং অর্থনৈতিক সুবিধা।

4. জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রভাব:
চীনের এক সন্তান নীতির ফলে দেশটি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও, দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব হিসাবে কর্মক্ষম জনসংখ্যার অভাব, বয়স্ক জনসংখ্যার বৃদ্ধি এবং লিঙ্গ ভারসাম্যহীনতা দেখা দেয়। বর্তমান নীতিগুলি এই সমস্যাগুলি সমাধানের লক্ষ্যে গৃহীত হয়েছে।

উপসংহার

চীন এবং ভারতের জনসংখ্যা নীতিতে মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। চীন একটি কঠোর জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ নীতি গ্রহণ করেছে, যার ফলে জন্মহার দ্রুত হ্রাস পেয়েছে কিন্তু এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছিল গুরুতর। অন্যদিকে, ভারত একটি তুলনামূলকভাবে নমনীয় এবং মহিলাদের ক্ষমতায়নের উপর ভিত্তি করে নীতি গ্রহণ করেছে, যা ধীরে ধীরে কাজ করেছে কিন্তু এখনো অনেক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন। দু’দেশের জনসংখ্যা নীতি তাদের নিজস্ব প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক ছিল, তবে উভয় দেশের জন্য জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সংযুক্ত সামাজিক, অর্থনৈতিক, এবং পরিবেশগত চ্যালেঞ্জগুলি রয়ে গেছে।